ek-basanter-golpo

এক বসন্তের গল্প


দরজা খুলতেই মেহুল অবাক, হাতে ঝোলা একটা চামড়ার ব্যাগ, একটা রুক্ষ-শুস্ক শীর্ণকায় চেহারা, উস্কোখুস্কো চুল, একটা না বলতে পারা ক্ষুধার্ত ক্লান্ত মানুষ, খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে মেহুল সে মানুষটি চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল।

বড় চেনা এই চোখ, যে চোখে অনেক দিনের জমে থাকা কান্নার নির্বিকার ইতিহাস, যেন পাতার পর পাতা লেখা হয়ে যাচ্ছে।

অদম্য উচ্ছাসে তার মনের দরজায়, এক নিঃশ্বাসে কেউ যেন সপাটে করাঘাত করে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঝড়ে বুকের ভেতরের সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। 

বেশ কিছুটা সময় মেহুল এভাবে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, সে বুঝতে পারল এই অচেনা মুখের আড়ালে তার হারিয়ে যাওয়া  প্রিয় জন অরণ্যকে।

সব পুরনো স্মৃতি ভেসে আসতে থাকলো একের পর এক স্মৃতি পেক্ষাপটে!

যে বসন্ত বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি টপার, যার পিছনে মেয়েদের লাইন লেগে যেত, যার  স্মার্টনেস দেখে, আমাদের কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েরা  তার অভিমুখে দৌড়াতে  থাকতো, সেই অরণ্য আজ উন্মাদের মত আমার সামনে দাঁড়িয়ে।

আমার কলেজে তেমন একটা পপুলারিটি ছিল না বললেই চলে, খুব গুটিয়ে রাখতাম নিজেকে।
কিন্তু আমার সে বসন্ত উৎসবের দিনে আজও মনে পড়ে। 

যেদিন আমি নিজেকে ডানা মেলে নীল দিগন্তে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেখানেই তোমার সাথে আমার প্রথম প্রেম আলাপ।

বাগান বাড়ির গান, লাল মাটির বুকের গন্ধ, দিকে দিকে এক মিষ্টি মাদকতা।
আর সকলে এক সুরে গাইছে -"ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল"
যেন সব রঙে মিশে গেছে, এই বসন্ত উৎসবে।
ধর্মের ছুঁৎমার্গ সামাজিক বিধিনিষেধ সব বিলীন হয়ে গেছে, এই অমলিন আনন্দ উৎসবে।

আর এইসব  কিছুর মাঝে আমার সাথে তোমার প্রথম আলিঙ্গন, সেখানেই তুমি আমার স্মৃতি রাঙ্গিয়ে দিয়েছিলে।

যখন বাসন্তিকা ফুলের ফাঁকে পূর্ণচন্দ্র, খোলা  মঞ্চে পিছন থেকে দেখা যাচ্ছিল, তখন তুমি আমার হাত ধরেছিলে। 

আমি খানিকটা ইতস্তত বোধ করেছিলাম, কিন্তু তোমার স্পর্শে আমি শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম, বুঝে গিয়েছিলাম আমার মনের প্রেমের জোয়ার এসেছে, তাকে আটকে রাখার সাধ্য আমার নেই।

" রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার রাঙিয়ে দিয়ে যাও"

 যেইনা গান শুরু অমনি আবির এর বটুয়া হাতে, নিয়ে সবাই মেতে ওঠে প্রকৃতির খেলায়।

তুমি আবিরের লাল রঙ্গে আর তোমার ভালোবাসা দিয়ে, আমাকে একেবারে নিজের করে নিলে।
 "যা ছিল কালো ধলো "

শুরু হলো বাতাসে আবিরের খেলা, যে খেলা আম্রকুঞ্জ বনে খিলখিলিয়ে হাসে নিত্যের ভঙ্গিতে।
এ যেন  এক নিঃশব্দ আলোড়ন  ঘটায় বাঙালি রুচিতে।
 
আমার আজও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে, তুমি আমাকে বুঝিয়ে ছিলে শুধু এখানে নয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশে এই বসন্ত উৎসব পালিত হয়  বিভিন্নভাবে।  

ইরান, চীন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, আরো কত কি আমি তোমার কথা শুনে এমন করে তোমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।

বসন্ত উৎসব, রবি ঠাকুরের গান, আর তোমার ভালোবাসা, এই সবকিছু মিলেমিশে আমাকে যেন জগতের সব সুখ ঢেলে দিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই পৃথিবীর সবথেকে সুখী আমি! আমি বসন্ত উৎসবে তোমায় পেয়েছিলাম বলে, তোমার নাম বসন্ত দিয়েছিলাম।

  আমার সেই ভাবনা যে কতটা ভুল তার প্রমাণ আমি, আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কিছুদিন পরেই বুঝতে পেরেছিলাম।

   যতদিন বাড়লো সংসারের চাপ ততই বাড়তে থাকল, তাই ফার্স্ট ইয়ারের পর আমার কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

    আমার পরিবারে আমি, মা, বাবা, আর দশ বছরের ছোট ভাই, অনেক কষ্টে দিন চলত আমাদের।

     তোমার পরিবারে তোমার বাবা-মা আর বিয়ে হয়ে যাওয়া এক ডিভোর্সি বোন, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার তোমাদের, যে পরিবারকে আমি আমার নিজের করে নিয়েছিলাম কিন্তু তোমরা তা পারোনি!

      অনেক কষ্ট হলেও সবটুকু সহ্য করে, সেই কষ্টের আজ আমি তোমার কাছে যেতে দিতাম না, বুঝতে দিই নি কখনো যে আমি ভালো নেই।

       তুমি সেই বছর চাকরির জন্য বিদেশে গেলে, এদিকে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, তোমার মা আর বোন বংশের ছেলে চাই বলে খোটা দিতে শুরু করলেন, নানারকম অসহনীয় কথাবার্তা।

তুমি যাওয়ার সময় বলে গেছিলে পরেরবার এ বসন্তে তুমি আমাকে, শান্তিনিকেতনের সেই জায়গায় নিয়ে যাবে।

কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু তুমি এলেনা! ডাক্তার বদ্যি  কবিরাজ কোনটাই বাদ গেল না।

 সংসারের নিয়মে নাকি একজন মেয়েকে মা না হলে তাকে কুলটা হতে হয়।

  দোষ শুধুমাত্র মেয়েটার।

  এদিকে একের পর এক ওষুধ, ডাক্তার, শিকড় বাঁটা, সবকিছু সাথে প্রায়শ্চিত্ত নীরবে সহ্য করেছি যন্ত্রনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।

   সেদিন রাত্রে খুব ঝড় হচ্ছিল , তোমার মা আর বোন আমাকে বললেন..... তোমাদের  গুরুর কাছে নিয়ে যাবেন।

   খানিকটা জোর করেই আমাকে তেনারা গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে, একটা নদীর পাড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন নদীর জলে।
    মানুষের কি ভাগ্যের পরিহাস দেখো, আমি বেঁচে গেলাম এক জেলের সহযোগিতায়।

    ঠিক করলাম আর নয়, এবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা ফিরব না আরো শ্বশুরবাড়িতে, অনেক কষ্টে আমি আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি।

     তোমার অনেক খোঁজ করেছিলাম অরণ্য!
      তুমি কোন  যোগাযোগ রাখো নি!

      কেন এরকম করলে মাঝ দরিয়ায় পড়ে অথৈ জলে আমি  ডুবতে বসেছিলাম।

       সবকিছু শুনে অরণ্য আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বলল, সে এক ভয়ানক অ্যাক্সিডেন্ট এতদিন কোমায় ছিল।

       সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আমার খোঁজ করে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে, সে আরও বলল যে এই সন্তান না হওয়ার পিছনে সব সমস্যা ছিল তার, সেসব জানতো কিন্তু লজ্জায় কাউকে জানাতে পারেনি।

        হাঁটু মুড়ে বসে অরণ্য বলল ফিরিয়ে দিও না মেহুল আমাকে, অনেক কষ্টের পর তোমাকে ফিরে পেয়েছি।

        চোখের জল গড়িয়ে পরতে থাকলো যেন বাদ কিছুতেই মানছে না।

         আমি অরণ্য কে জড়িয়ে ধরলাম, আর দূর থেকে গান ভেসে আসলো
         "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল"
          অরণ্য চিৎকার করে বলে উঠলো, মেহুল আজ বসন্ত উৎসব।
          চলো আজ আমরা আবার গাইব।
       "প্রেমের ও জোয়ারে ভাসাবো দোহারে বাঁধন খুলে দাও দাও দাও"


******************************************************

কলমে- সাথী মহাপাত্র

9 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.

  1. বেশ ভালো লাগলো। আপনার ব্লগটিকে ইতিমধ্যেই বুকমার্ক করে রেখেছি, নিয়মিত পড়তে আসব বলে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই গল্পটি পাঠ করতে পারি ??

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন