valobasar-chothi-choto-golpo

অপূর্ন ভালোবাসার চিঠি


তিতলি আর সুরজিৎ এর বন্ধুত্বটা শুরু হয়  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু, একেবারে হরিহর আত্মা। চাকুরী সূত্রে তিতলির বাবার পোস্টিং ছিলো সুরজিৎ দের গ্রামে। পেশায় তিনি ফরেস্ট অফিসের রেঞ্জার। তারপর তিতলির  পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার  বাবার বদলি হয়ে যাওয়ায় বিচ্ছেদ ঘটে বন্ধুত্বে। 

দশ বছর পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের কাউন্সিলিং এর দিন সুরজিৎ দেখতে পায় তিতলিকে। তিতলির জন্য তার মনে জমে থাকা আবেগ একটা চিঠির মধ্যে লিপিবদ্ধ করে সুরজিৎ। যে চিঠিটা লেখা হলেও প্রেরিত হয়নি।

 
প্ৰিয় বন্ধু
তিতলি,
      
            তোকে আজ বছর দশেক পরে দেখলাম। প্রথমে আমি তোকে চিনতে পারিনি। তারপর কাউন্সিলিং এর এনাউন্সমেন্টে "তিতলি পাত্র" নামটা শুনে চমকে উঠলাম। তারপর ভাবলাম এই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তুই কোথা থেকে আসবি! তাও আবার বাংলা সাহিত্যের  স্নাতোকোত্তর এর কাউন্সিলিং এ!

           তোর তো কোনোদিন সাহিত্যে আগ্রহই ছিলোনা। একেই নামে অনেকেই থাকে তো। তাই ভাবলাম এ অন্য কেউ হবে। ভুল ভাঙলো যখন কাউন্সিলিং রুমে তোর সাথে তোর বাবাকে যেতে দেখলাম। নিশ্চিত হলাম এ আমার সেই ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই বন্ধু তিতলি। অনেক বদলে গেছে তোর মুখের অবয়বটা। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো তোকে। আমার সেই ছোটোবেলার বন্ধু তিতলির সাথে বিশেষ কোনো মিল নেই। নেই সেই ফোকলা দাঁতের মিষ্টি হাসিটাও। 

             আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে তোর স্কুলে আসার প্রথম দিনটি। তোর বাবা তোকে ভর্তি করে দিয়ে গেলেন আমাদের স্কুলে। তারপর স্নেহা মিস তোকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেখানেই শুরু হলো আমাদের বন্ধুত্বের। আচ্ছা তোর মনে আছে.... তুই আমার মায়ের হাতের রান্না পছন্দ করতিস বলে তুই আমার টিফিনটা খেতিস আর আমি তোরটা? কিত্ কিত্, কাবাডি, চোর -পুলিশ, কুমির-ডাঙ্গা খেলার  সেই দিনগুলো মনে আছে তোর? 

           পুতুল খেলায় তোর "টুকাই আর বাবুসোনার" বাবা হতাম আমি আর তুই হতিস মা।  তুই আসার আগে আমি স্কুলে ফার্স্ট হতাম। কিন্তু তুই এসে আমার জায়গাটা দখল করে নেওয়ায় রাগ হয়েছিল খুব তোর উপরে। তাই তোর হোমওয়ার্ক এর খাতাটা আমি লুকিয়ে দিয়েছিলাম যাতে তুই ক্লাস টিচার এর কাছে মার খাস। 

          আবার তুই যখন মার খেয়ে কান্নাকাটি করছিলি... কেনো জানিনা খুব খারাপ লেগেছিলো আমার। নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। কিন্তু তোকে সত্যিটা বলার সাহস করিনি, পাছে বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়। 

           আচ্ছা, মনে পড়ে তোর সেই দিনটার কথা?  সেই স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তুই একা নাম দিতে সাহস পাচ্ছিলি না বলে আমরা একসঙ্গে "দস্তানা" কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলাম?  

          আসলে সত্যি বলতে কি আমিও একা আবৃত্তি করার সাহস পাচ্ছিলাম না। আর তুই ভাবলি স্টেজে উঠে পারফর্ম করতে আমি ওস্তাদ। 
 

            এভাবেই হেসে খেলে কাটছিলো  আমাদের শৈশব। তারপর হঠাৎ একদিন তোর বাবার বদলি হয়ে গেলো। আর আমি হারিয়ে ফেললাম আমার ছোট্ট বন্ধুটিকে। তখন তো আর এখনের মতো মোবাইল ফোন আবিষ্কার হয়নি, হলে হয়তো নাম্বার বিনিময়টা করে নিতাম। ভাবলাম হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের মতো। কখনই ভাবিনি এভাবে দেখা হয়ে যাবে আবার। যাওয়ার সময় তোর 'টুকাই ' নামক পুতুলটাকে আমার কাছে দিয়ে গিয়েছিলি। যেটা আজও আমি সামলে রেখেছি। 'বাবুসোনার' খবর কি রে? আছে? না হারিয়ে ফেলেছিস? 

           সত্যি বলতে কি.... প্রথমটায় একটু ইতস্তত করছিলাম দেখা করতে যাবো কিনা। ভয় হচ্ছিলো, পাছে তুই আমায় চিনতে না পারিস। তারপর সাহস সঞ্চয় করে চলেই গেলাম। তোর বাবাকে টুক করে একটা প্রণাম করে জিজ্ঞেস করলাম, "মেসোমশাই ভালো আছেন?  চিনতে পারছেন আমায়? " উনি কিন্তু আমাকে চিনতে পেরেছিলেন।


         বললেন, "তুমি সুরজিৎ না? " আমি বললাম, "হ্যাঁ, ঠিকেই ধরেছেন।" আমি লক্ষ্য করলাম তোর চোখের অপ্রস্তুত ভাব। পরিষ্কার বুঝলাম মুছে গেছি আমি তোর স্মৃতি থেকে। তুই যে আমার কথা ভুলে গেছিস সেটা বুঝতে না দিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললি, "তোমাকে আবার চিনবো না সুরজিৎ.... তাও কখনো হয়?" আমি আর তোকে মনে করিয়ে দিলাম না যে তুই আমাকে কখনই "তুমি " দিয়ে সম্বোধন করিস নি। সেদিন তুই আমার কাছে নাম্বারটা নিয়ে রাখলি তোর বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করবি বলে। 

          তুই হয়তো আমার চোখের দিকে লক্ষ্য করিসনি। চোখের পাতা গুলো ভিজেছিলো ঠিকই কিন্তু আবেগকে অশ্রু রূপে নেমে আসতে দিইনি। 

         আমরা পুরুষ মানুষ না? কান্না আমাদের মানা। নিজের মনে মনেই ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম তুই যেন সারাজীবন ভালো থাকিস।
                                          

                                                                                   ইতি
                                                                                 সুরজিৎ।


*******************************************************

কলমে : সৌরভ সৎপতি।

1 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন