করোনার ভয়
Bangla Golpo |
জানালা দিয়ে সূর্যের রশ্মি চোখে পড়তেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল,শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে,মনে হয় জ্বর হয়েছে আর গলাটাও যেন ধরে গেছে,কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
আচ্ছা আমার করোনা হলো না তো মনের মধ্যে তিব্র একটা ভয়ের সৃষ্টি হলো, কী করবো কিছু মাথায় আসছে না, আমি একাই কলকাতার একটা রুমে থাকি মা বাবা বোন গ্রামে থাকে। রুম থেকে না বেরিয়ে বাবাকে কল করে সবটা জানালাম, বাবাও হতভম্ব হয়ে গেল,তারপর এম্বুলেন্স পরিষেবায় কল করলাম কিন্তু ওরা বলল এখন একটাও এম্বুলেন্স ফ্রি নেই আর আশে পাশে কিছু জনের নাম্বারে কল করলেও কোনো গাড়ি আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছে না।কী করবো না করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না ভয় হচ্ছিল খুব হয়তো বিনা চিকিৎসায় প্রান হারাতে হবে আমায়।বাবা বারবার কল করছে মা নাকি কান্না শুরু করে দিয়েছে,শেষ পর্যন্ত ৩ ঘন্টা পরে হেল্পলাইন থেকে রেসপন্স এলো, কিছুক্ষন পর এম্বুলেন্সে করে কিছু জন এসে আমাকে পিপি কিট পরিয়ে নিয়ে গেল,মনে মনে ভাবলাম হয়তো বাবা মায়ের সাথে শেষ দেখাটাও হবে না।
যখন জানতে পারলাম, সত্যিই আমিও করোনা নামক বিষাক্ত ভাইরাসে আক্রান্ত খুব ভয় করছিল। দুজন নার্স আর একজন ডাক্তার আমাকে পুনরায় চেকাপ করিয়ে নির্দিষ্ট একটা বেডে নিয়ে আসে। এখানে আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে উনারা চলে যায়। আমি বেডে শুয়ে আছি। আমার বেডের চারপাশে পলিথিনের মতো কি যেনো দিয়ে আবৃত। হাতের মধ্যেমা আঙ্গুলে কি যেনো দেওয়া। মাথার ডান পাশে অক্সিজেন মাস্ক। মনে হচ্ছে কারা যেন বন্দি খাঁচার আটকে রেখেছে। বেড থেকে উঠে বসলাম, যত সময় যাচ্ছে একাকিত্ব গ্রাস করেছে আমায়। সামনের পর্দা সরাতেই দেখলাম, কাঁচের দেওয়াল। অবাক হলাম না, জানতাম এমনি হবে। দেওয়ালের ওপাশে কেউ নেই, মাঝে মধ্যে দু-একজন নার্স যাতায়াত করছে। রুমের পশ্চিম দিকে একটা দেওয়ালে ছোট্ট জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্য ডুবছে,মনে মনে ভাবলাম আমিও বেলা শেষে ডুবে যাওয়া সূর্য্যের মতো জানিনা কখন আমার জীবনের আলোটা আমাকে না জানিয়েই হঠাৎ করেই নিভে যাবে। নীরব মনে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি।
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘোর কাটে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি সম্পূর্ণ প্রোটেকশন নিয়ে একজন নার্স আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে ঔষধের থালা, অপর পাশে খাবার, আর আমার পছন্দের কিছু ফল। ফলগুলো মনে হয় বাবা পাঠিয়েছে। নার্সটা কিছুটা দূর থেকে বলে খাবারের পর মেডিসিন গুলো খেয়ে নাও। এটুকু বলে নার্সটা চলে যায়। এখন আর খেতে ইচ্ছা করছেনা। চোখের পাতাটা ভারি হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালাম দেখি রাত ১২টা বাজে। আশে পাশের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি চোখ ঘুরিয়ে উত্তর পার্শ্বে চোখ পড়তেই দেখলাম, তিন-চার বছরের একটা বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে নাকে অক্সিজেন মাস্ক। কি সুন্দর গুছিয়েই না ঘুমাচ্ছে ,ছোট বাচ্চার এমন পরিস্থিতি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি চোখ বুজে ঘুমের আশায় প্রহর গুনছি ঘুমেরা আমার কাছে ধরা দিচ্ছেনা।
পরের দিন সকালের চেকাপে জানতে পারলাম জ্বর আরো বেড়েছে শুনে একটুও কষ্ট হয়নি কারন আমার বাঁচার ইচ্ছে ছিল না কারন এতো বড়ো হয়ে গেলাম একটা চাকরি জোগাড় পারিনি আবার এই লগডাউনে বাবার পাশেও দাঁড়াতে পারিনি কাজের সূত্রে কলকাতাতে এসে এই বিপদ। কিছুক্ষন পর নার্স জানালো আমার বাবা, মা বোন দেখা করতে এসেছে। কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে বাবা মা বোন দাঁড়িয়ে আমরা কতইনা কাছে তবুও কতদূরে, মাঝখানে কাঁচের দেওয়াল। সবাই কাঁদছে অঝরে কাঁদছে। আমি ওদের দিকে দেখে একটু কাঁদতেও পারছি না হয়তো মানুষ বেশি কষ্ট পেলে কাঁদতে ভুলে যায়।
চার দেওয়ালের মধ্যে কখন ভোর হচ্ছে কখন সন্ধ্যা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে না দেখতে দেখতে বিকেল ৩ টা বাজে একা শুয়ে আছি,মনে হচ্ছে কতদিন হয়ে গেলো ফোন হাতে নেইনি।ফোনটাও কোথায় জানি না একজন নার্সকে আমার ফোনের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলল ফোন ব্যবহার নিষেধ তবুও বারবার রিকুয়েস্ট করে ফোনটা হাতে পেলাম। লক খুলতেই দেখি অনেক গুলো কল, অনেক গুলো মেসেজ। ফোন ব্যাক করতে চাইলেও আর ব্যাক করা হয়ে উঠেনা কথা বলতে পারিনা যে। চাইলেই আর বন্ধু-বান্ধবের শান্তনামূলক মেসেজের রিপ্লাই করতে পারিনা, শরীর যে আর সায় দেয়না।
Bangla Choto Golpo |
অনেক কষ্টে মেসেজ টাইপ করলাম আমার বোনকে।
" লক্ষীটা আমাকে মাফ করে
দিস। তোদের খারাপ সময়টাতে
আমি পাশে থাকতে পারবোনা রে।
তোর করা দুষ্টুমি গুলো ভীষন
মিস করছি রে। জানি আমি মারা
গেলে হয়তো আমার মৃত দেহ দেখতেও দেবে না।
জানিস এ বিষয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই।
তবে আমাকে নিয়ে বাবা মায়ের
অনেক স্বপ্ন ছিলো। একমাত্র
আদরের ছেলে ছিলাম তো।
আমি আর তুই ছাড়া আমাদের বাবা মাকে
দেখার মতো কেউ নেই রে,
তোর তো বিয়ে হয়ে যাবে। প্লিজ
লক্ষি বোনটি আমাদের বাবা মাকে
দেখে রাখিস,তুইও ভালো থাকিস"
মেসেজ করেই ফোনে বাবা মায়ের ছবিটাকে দেখে কাঁদছি।
সন্ধ্যার সময় কোথা থেকে যেন এক শীতল বাতাসের স্পর্শে মনে হচ্ছে প্রকৃতি জীবনটাকে উপভোগ করার আহ্বান জানাচ্ছে। জীবনের অন্তিম মুহুর্তে এসে বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা তীব্র থেকে অতি তীব্র হচ্ছে। যদি আর একটুখানি বাঁচতে পারতাম। অনেক কিছু বলার ছিলো। অনেক কিছু করার ছিল।"
চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠেছে।মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। নিঃশ্বাস নিতেও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। চোখ খুলতে পারছিনা। কানে মাঝে মাঝে আওয়াজ ভেসে আসছে ডিজিটাল যন্ত্রের টিট টিট। একটু পর আর কোনো আওয়াজ কানে আসছেনা। অনেক চেষ্টা করছি চোখ খোলার, হাত নাড়ানোর তবুও পারছিনা প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে বাবা, মা,বোনের ছবি ভেসে উঠছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে আর একটু খানি বাঁচতে চাই। শরীরটা ধীরে ধীরে ঝিম মেরে আসছে। ডিজিটাল যন্ত্রটা বিপ... শব্দে থেমে গেলো। হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, চোখ চেয়ে দেখি আমি বেডে,আমার সামনে নার্স দাঁড়িয়ে কী যেন লিখছে। প্রচন্ড ভয়ে আমি শ্বাস নিতে পারছি না, কষ্ট হচ্ছে খুব।নার্সটা তাড়াতাড়ি এসে অক্সিজেন মাস্কটা আমাকে পরিয়ে দিল।আর হাতে একটা ইনজেকশন দিতেই আমি আবার ঘুমে ঢলে পড়লাম।
চোখ খুলতেই নার্স জানাল আমার জ্বর কমে গেছে, আমিও রীতিমত সুস্থ অনুভব করছি শুধু শরীরটা একটু দুর্বল। বিকেলে আমায় হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে আমি বাবা মায়ের কাছে চলে যাই সেখানে একটা রুমে কিছুদিন একাই ছিলাম এখন পুরোপুরি সুস্থ গ্রামে এতটা করোনার আতঙ্ক নেই।রাস্তায় একা হাঁটছি আর চারপাশে সবুজ মাঠ,ঘাট এখানে কেবল শান্তি আর সেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ।।
সমাপ্ত
লেখা: প্রিয় 🌸🍁
বি দ্র : করোনা প্রচুর পরিমাণে সংক্রমণ হচ্ছে। মাস্ক ব্যবহার করুন,সাবধানে থাকুন,সতর্ক থাকুন। আল্লাহ্, ভগবান, God সবার ভালো করবে।।
প্রথম বার করোনা নিয়ে কোনো গল্প, ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। কমেন্টে জানিও কেমন লাগলো।সবার সুস্থতা কামনা করি।
#Bangla_Choto_Golpo #Bengali_short_Stories #Golpomala #Choto_Golpo
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.