গৃহবধূর_কলমে
সরজিৎ_ঘোষ
বিয়ে হয়ে যেদিন এ বাড়িতে প্রথম পা রাখলাম আমাকে আমার শাশুড়ি বলে গেলেন, ---তুমি এ বাড়ির বৌ। তাই বাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে সেগুলো তোমাকে মেনে চলতে হবে। নিয়ম কানুন গুলো যে কী সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি। পরে পরে বুঝেছিলাম সেই নিয়ম কানুন। নিয়ম আর কিছুই নয় শাশুড়ি যে কথা গুলো বলবেন সে গুলোই শুনে চলতে হবে।
বিয়ের আগে একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরি করতাম। শাশুড়ি বলে দিলেন, -চাকরি যদি করবে তবে বিয়ে করলে কেন? তাও যদি জানতাম ওটা সরকারি চাকরি, তখন না হয় ওটা ভেবে দেখা যেত।
তবে এমন কথা শুনে আমার ততটা খারাপ লাগে নি। কারণ বিয়ের আগে আমার মাও ঠিক এমন কথাই বলেছিল, -ওই তো একটা সামান্য চাকরি। সরকারি চাকরি তো নয় যে চাকরিটা ছাড়া যাবে না। ভালো সরকারি চাকরি করা ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে তোর। কী দরকার আর চাকরি করার? ওই রকম একটা চাকরি পরেও পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এখনকার দিনে একটা ভালো ছেলে পাওয়া খুব মুশকিল। চেনা জানার মধ্যে, তারপর কোনো রকম নেশা টেশা নেই। বেশির ভাগ বাড়িতেই মেয়েদের চাকরি অপেক্ষা বিয়ে দিয়ে সংসারী হওয়াতেই পছন্দ করে বেশি।
আমি শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমরা বেশির ভাগ মেয়েই বাপের বাড়িতে অর্ধেকটা হেরে আসি। বিয়ের পর শাশুড়ির নিয়ম কানুন মানতে গিয়ে আমি বুঝেছিলাম আমি বাড়ির বৌ। বাড়ির বৌ আর মেয়ের মধ্যে অনেক তফাৎ। বৌ মানেই সেবাময়ী আর স্বার্থত্যাগী হতে হয়। বৌ মানে সে কখনো আগে খেতে বসতে পারবে না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম খুব ইচ্ছে হতো আমি আর আমার স্বামী এক সঙ্গে খেতে বসব। না সেটা হয়নি। শাশুড়ি বলতেন, বাড়ির ছেলেরা আগে খেতে বসবে। ওদের খাওয়া শেষ হলে তারপর তুমি সবার শেষে খাবে। আমার স্বামীও কোনো দিন বলেনি দুজনে এক সাথে খেতে বসি। উনিও নির্বিকার চিত্তে খেয়ে উঠে যেতেন। খারাপ লাগতো। কিন্তু মুখে বলতে পারতাম না। কারণ ওটা নাকি বাড়ির নিয়ম। যে নিয়ম গুলো মেনে চললে খারাপ থাকতে হয় সেটাই মেনে চলতে হয়।
আর বাড়ির কাজ কর্ম? না। কোনো দিন আমাকে হেল্প করেনি আমার স্বামী। একদিন আমার স্বামীকে বলে ছিলাম, --তোমার খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো থালাটা তুলে নিয়ে যেও। শাশুড়ি আমাকে সেদিন দু চার কথা শুনিয়ে বলেছিল, আমার ছেলে এক গ্লাস জল নিয়ে কখনো খায় না। আর তুমি ওকে এঁটো বাসন তুলতে বলছো? মেয়েলি কাজ আমার ছেলেকে দিয়ে করাবে না কখনো। বাড়ির ছেলে মানে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে? আর বাড়ির সব কাজ বাড়ির বৌ করবে। এটাই নাকি বাড়ির নিয়ম। শরীর খারাপ বা যদি কোনোদিন অসুস্থ থাকতাম তাহলে খাবার বা ওষুধ নিয়ে কেউ আসত না আমার ঘরে। আমি অসুস্থ মানে আমাকেই আমার খেয়াল রাখতে হবে। ওষুধ বা খাবার নিজেকে নিয়ে খেতে হবে। আর বাড়ির কেউ অসুস্থ হলে সেটাও আমাকেই খেয়াল রাখতে হবে। কারণ আমি বাড়ির বৌ। আর বাপের বাড়ি যেতে হলে আগে থেকে শাশুড়িকে বলে রাখতে হতো। অফিসে বসের কাছে যেমন ছুটি লেখাতে হয় ঠিক তেমনি। বিয়ের পর আবার বাপের বাড়ি বেশি যেতে নেই এমনটাই ধারণা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের।
আমার এই বাপের বাড়ি যাওয়াটা পছন্দ করত না আমার স্বামী আর শাশুড়ি দুজনেই। বাপের বাড়ি থেকে আসার পর যদি কোনো কিছু একটা ভুল ত্রুটি হতো আমার শাশুড়ি বলতেন, ---ঘন ঘন বাপের বাড়ি গেলে ওরকমই হয়। ভালো কিছু তো কোনো দিনই শিখে আসলে না। কিছু ভুল হলেই দোষ গিয়ে পড়ে বাবা মায়ের ওপর। বাবা মা নাকি কিছুই শেখাতে পারেনি।
আজ পনেরো বছর হলো আমার বিয়ে হয়েছে। বিয়ে করে আমি এখন সংসারী মানুষ। বাড়িতে আমরা ছয় জন সদস্য। শ্বশুর শাশুড়ি আমার হ্যাজব্যাণ্ড আর আর আমার ছেলে মেয়ে। ছেলে বড়ো, ছেলের থেকে মেয়ে তিন বছরের ছোটো। বিয়ের প্রথম ছয় বছর আমি সব কিছু মেনে নিলেও তারপর থেকে আর কিছু মানতে পারলাম না। ভাবলাম এই ভাবে যদি সব কিছু মেনে নিতে থাকি তাহলে এই মেনে নেওয়াটাই একটা ট্রাডিশান হয়ে যায়। তাই নিজেকে বদলে নিলাম। আমার খারাপ লাগা গুলো যেন আমার ছেলে মেয়ের মধ্যে সঞ্চারিত না হয়। এই বদলানোর ব্যাপারটা শুরু করলাম আমার মেয়ে হওয়ার পর থেকে। ছেলে মেয়েরা ছোটো থেকেই বাড়িতে যা দেখবে তাই শিখবে। নিয়ম রীতির পরিবর্তনের দরকার আছে। বাড়ির যে নিয়ম গুলো আমাকে মানতে বাধ্য করা হচ্ছিল সেগুলো থেকে বের হতে না পারলে আগামী দিনে আমার ছেলে মেয়েও সেই ভাবেই তৈরী হবে। তবে এই ব্যাপারে আমার শাশুড়ির সাথে আমার ঝামেলা বাঁধত।
আমার মেয়ের যখন অন্নপ্রাশন হবে তখন শাশুড়িই বললো, অতো বড়ো অনুষ্ঠান করার দরকার নেই। আমাদের বাড়িতে মেয়েদের ঘটা করে কিছু হয় না। আমি শুনে বললাম, ঘটা করেই হবে। কারণ আমার কাছে দুটোই আমার সন্তান। মেয়েকে মেয়ে হিসেবে না দেখে সন্তান হিসেবে দেখি। তাই ছেলে আর মেয়ে দুজনের মধ্যে আলাদা করে কোনো কিছু দেখতে রাজি নই। শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হলেও মেয়ের অন্নপ্রাশন আমি ঘটা করেই করি। ছেলে আর মেয়েকে সমান চোখে দেখাটাই উচিত।
বছর তিনেক আগে আমি মেয়েকে তবলার স্কুলে ভর্তি করালাম। মেয়ের সখ তবলা শিখবে। আমার স্বামী আমাকে বললো, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ছেলেকে তবলা না শিখিয়ে মেয়েকে শেখাচ্ছ? তবলা শেখার জন্য আবার ছেলে মেয়েকে আলাদা করে দেখতে হয় নাকি? ওর যেটা ইচ্ছে সেটাই ও শিখবে। আমি কিন্তু স্বামীর কথা শুনে পিছিয়ে আসিনি। মেয়ে তবলা শিখছে। এবং বেশ ভালো বাজায়। আমি এটা দেখে আনন্দ পাই ছেলে গান করে তার সাথে মেয়ে তবলা বাজায়। তবে শাশুড়ির সাথে একদিন বড়ো ঝামেলা হলো একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে। বিষয়টা আমার কাছে সাধারণ হলেও শাশুড়ির কাছে সেটা অশোভন লেগেছিল। ছেলেকে বললাম, --বোনের খিদে পেয়েছে। আমি তো একটা কাজ করছি। তুই বোনকে খেতে দিয়ে দে। শাশুড়ি শুনতে পেয়ে বলে, --কাকে দিয়ে কী কাজ করাচ্ছ? ও ছেলে। মেয়েলি কাজ গুলো ওকে অন্তত শিখিও না। কোনো কাজ ছেলে বা মেয়ের আলাদা কিছু নেই মা। তাই যে কাজটা মেয়েলি বলে অসম্মান করছেন সেই কাজটাকে ছোটো করে দেখাটাও তো উচিত নয়। -তা বলে তুমি ছেলেকে বলবে খেতে দিতে? -আসলে সব কাজ সবার শেখা উচিত। ছেলে মানে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে সেটা হতে পারে না। ঘরের কাজ নিজে করতে শিখলে অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় না।
Youtube Audio Link- https://youtu.be/NKXyewvtT10
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.