সুখের সংসার

bangla_choto_golpo_sukher_sangsar
Golpomala
                                     Bangla Choto Golpo

আমার আর আদির নতুন বিয়ে হয়েছে, হুম আমাদের লাভ মেরেজ তবে আমাদের বাবা মা এতে কোনো বাধা না দিয়ে বরং আমাদের সাহায্যই করেছেন,পুরো আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘটা করে বিয়ে দিয়েছেন আমাদের।

নতুন সংসারে সবাই নতুন হলেও এখানে নিজেকে মানিয়ে তুলতে কোনো অসুবিধা হয়নি।আমার প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে যায় যদিও এটা নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। তবুও আজ ইচ্ছে হলো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সব কাজ একা করবো, কথা মতো সকালে উঠে রান্না ঘরে তরকারি চাপিয়ে ছাদে জামা গুলো শুকাতে দিচ্ছিলাম হঠাৎ কেমন যেন একটা পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ আসছে নাকে। ইশ গ্যাসে যে তরকারি হচ্ছিলো, জামা কাপড়গুলো মেলা বাদ দিয়েই ছুটলাম রান্নাঘরের দিকে। যেয়ে দেখি মা(শাশুড়ি) গ্যাসটা কমিয়ে দিচ্ছেন।

~ মা আসলে, আমি জামা কাপড় গুলো ধুয়ে মিলছিলাম,আমার একটুও মনে ছিলোনা।
- আচ্ছা বেশ কাপড় গুলো মেলে দিয়ে আসো খাবার টেবিলে।
~ কিন্তু মা তরকারিটাতো পুঁড়ে গেছে। আগের বারের মতো আবার রান্না খারাপ করে দিলাম আমি।


-সমস্যা নেই খুব বেশি পুঁড়ে যায়নি। অন্য সব খাবার এর সাথে বোঝা যাবেনা তেমন। আর তোমায় কে বলেছিলো আমার আগে উঠতে? কতদিন বলবো তুমি এখনো অনেক ছোটো সংসারটা বুঝে উঠতে আরো সময় লাগবে। এখনি এতো কাজ করতে বলিনি তোমায় বুঝেছো?

~মা তুমিতো রোজ ভোরে ওঠো, আমায় কিচ্ছু করতেই দাওনা। তাই আমি আজ ভোরে উঠে কাজ করব বলে এলার্ম দিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু কে জানতো এমন জটলা বাধিয়ে ফেলবো।

- ধুর পাগলি, আমি থাকতে তোমাকে এখনি এতো কাজ করতে হবেনা। পুরোটা জীবন পরে আছে তখন দেখবো আর কী কী জটলা বাঁধাও হাহাহা...!


তারপর ছাদে যেয়ে দেখি বাবা(শশুর) সব মিলে দিয়েছেন।
- বাবা আমি আসছিলাম শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন কেন?
~ আরে মা, এতে কষ্ট হয় না। সব কাজ মিলেমিশে করলে বরং আনন্দই হয়।

বাবার কথাটা শুনে মনটা আরো ভালো হয়ে গেল।

- আসুন বাবা খাওয়ার টেবিলে রান্না হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে খুব অবাক হই, মানুষ কি করে এতোটা ভালো হতে পারে।এই নিয়ে এক সপ্তাহে দুইদিন তরকারি পুড়লাম। গত সপ্তাহেতো বাবার পছন্দের চিংড়ি মাছের মালাইকারিটায় লবনটাই বেশি দিয়ে ফেলছিলাম। সে কি লজ্জা আমার! তবুও বাবা তৃপ্তি সহকারে খেয়ে উঠলেন। আর মা? সে তো বরাবরই বলেন যে আমার হাতে নাকি জাদু আছে রান্না খেয়ে পেট একদম ভরে যায়। অথচ সেই একই রান্না আমি খেতে পারি না। রান্নার 'র' ও জানতামনা, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি কখনো কোনো কাজ করতে হয়নি। তাই ঘর গোছানোর বাইরে বেশি কিছু জানতামনা। এ বাড়িতে যখন প্রথম পা রাখি সেদিনই আমার শাশুড়ি বলেছিলেন, "আমার একটা মেয়ে চাই, ছেলের বউ নয়"। সেদিনই বুঝেছিলাম আমার ভাগ্যটা ভীষন ভালো।

কতটা ভালো মনের মানুষ হলে কেউ ছেলের বউ কে হাতে কলমে শিখিয়ে নেয়, তা বাবা মা কে না দেখলে বুঝতামইনা।

শাড়ি পড়তে তেমন অভ্যস্ত নই তাই প্রতিদিন মা হেল্প করে দেয়, আজ একা একা শাড়ি পড়ে নিয়েছি তবে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে পারছিলাম না, মা রান্না করতে ব্যস্ত থাকায় বাবাকে বলতে বাবাই শাড়ির কুঁচি ধরে দিচ্ছিল, এতে লজ্জা পাওয়ার থেকে নিজেকে বেশি ভাগ্যবান মনে হয়েছিল।

সেই দিন সন্ধ্যায় আদি ফোন করে বলল অফিসের কাজে আজ বাড়ি আসতে পারবে না। তাই সন্ধ্যায় নাস্তা করতে করতে মায়ের সাথে গল্প করছিলাম, কথা বলতে বলতে মজা করে বলছিলাম অনেক দিন আইসক্রিম খাইনি আগে বন্ধুদের সাথে কত আইসক্রিম খেতাম,ও এলে বলব আমাদের সবার জন্য আইসক্রিম আনতে।

কিছুক্ষন পর একটা চকলেট আইসক্রিম সামনে এনে বলল এই নে আইসক্রিম, আমি মুখ তুলে দেখি বাবা এনেছে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, আমি তো মাকে গল্প বলছিলাম,বাবা কী করে জানলো।

তখন বাবা বলল ধর তাড়াতাড়ি তোর মায়ের জন্যেও এনেছি, আমি বাইরে থেকে শুনেছি সব,তুই আমার মেয়ের মতোই তোর ইচ্ছে সখ আল্লাদ মানে আমাদের সখ আল্লাদ।


পরের দিন,

খাবার টেবিলে আমি খাবার গুলো সাজিয়ে রাখছিলাম। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলতেই দেখি পাশের বাড়ির আন্টি এসেছেন। আমি  ভিতরে আসতে বললাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মা কোথায়? আমি বললাম রান্না ঘরে।  

উনি মা এর সাথে গল্প করতে রান্না ঘরে চলে গেলেন।

আমি টেবিলে বসে সব গোছাচ্ছিলাম। বাইরে থেকে স্পষ্ট সব শোনা যাচ্ছিলো। কথা শেষে বাড়ি চলে যাওয়ার সময় আন্টি মা কে বললেন,

- দিদি আর কতো খাটবেন? ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন কি করতে? বউ কে বসিয়ে রেখে রান্না করে খাওয়াইতে? এই করোনা দিনেও এতো এতো রান্না করছেন আপনি?

এই দেখুন না  আমার  কি সুন্দর কপাল, ছেলের বউকে দিয়ে সব রান্না করাই। আমার কিছু করতেই হয়না। এইতো এখনো দেখে আসলাম আমার ছেলের বউ রান্না করছে নানা রকমের তরকারি। সেই জন্যই বলছিলাম এতো ভালো হয়ো না দেখবেন ছেলের বউ মাথায় উঠে বসবে। পরে আর নামাতে পারবেন না।


কথাগুলো শুনে খুব খারাপ লাগছিলো আমার

কিন্তু খেয়াল করলাম মা একটা কথাও বলছেন না,অনবরত রান্না নাড়াচাড়া আওয়াজ করেই যাচ্ছেন।

সবটা চুপচাপ শোনার পর মা বললেন,

দিদি আজকে খাওয়া দাওয়াটা এখানেই করে যান, আমার বউমা অনেক ভালো পোলাও বানাতে পারে।একবার খেলে ভুলতেই পারবেন না। আর দিদি আমি বলি কি, সবসময় বিশ্রামের কথা না ভেবে নিজের বউমাকেও একটু হাতে হাতে সাহায্য করুন দেখবেন খুব ভালো লাগবে আপনারও আর আপনার বউমাটারও।


মায়ের কথাগুলো শুনে ভেতরটা যেন শীতল হয়ে গেলো। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম রান্নাঘরের দিকে।দেখলাম আন্টি চুপচাপ মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলেন।

রান্নাঘরের দিকে গেলাম, যেয়ে মা কে জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা মা তুমি এতোটা ভালো কেন?" মা মিষ্টি হেসে জবাব দিলো তোমার জন্য।

ভুলে যেওনা আমিও তোমার মতো এই সংসারে এসেছিলাম।একটা প্লেট কি করে ধুয়ে ভাত বেড়ে খেতে হয় জানতামনা কখনো।কিন্তু আমার শাশুড়ি আমায় নিজের মেয়ের মতো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছিলো।কখনো কোনো বকা দিয়ে কথা বলতোনা, একটা কাজ হাজারবার ভুল করতাম কিন্তু তিনি বুঝিয়ে উৎসাহ দিয়ে সেই কাজটা আবার করিয়ে দিতেন। সবটাই ভালোবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন, কখনো চোখ রাঙ্গিয়ে নয়।


মনে মনে ভগবানের কাছে ধন্যবাদ জানালাম,
আমায় এতো ভালো আরেকটা মা বাবা দেওয়ার জন্য।

আজকে আবার চিংড়ি মাছের তরকারিটা আমিই রান্না করেছি। মা পুরোটা সময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।  তাই বুঝি আজ পোড়া টোরা ছাড়াই কিছুটা পার্ফেক্ট তরকারি হয়েছে।

অপেক্ষা করছি বাবার কী বলে শোনার জন্য.....

বাবা আমার রান্না করা চিংড়ি মাছের মালাইকারি খেতে খেতে বললেন, বাহ্ এইনা হলে আমার মেয়ের হাতের রান্না। কাল কিন্তু খাসির মাংসটা আমার মেয়েই রান্না করবে। আমি অানমনে ভাবছি বাবা হয়তো আজকেও আমার মন রাখতেই এগুলো বলছে কিন্তু সেই ধারণাটা বদলে গেলো মূহুর্তেই, মুখের সামনে হাত দিয়ে ভাত তুলে ধরলো কেউ, তাকিয়ে দেখি মা। আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো, হা করতেই মা খাবারটা মুখে দিয়ে দিলেন। সত্যিতো আজ তরকারিটা খুব ভালো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার টেবিলটা সবার হাসির শব্দে মুখোরিত হয়ে উঠলো। নিজেকে তখন মনে হচ্ছিলো যেন কঠিন পরীক্ষায় সদ্য পাস করা ছাত্রী।

মা কে বললাম মা, কাল যদি আবার খাসির মাংসটা পুড়িয়ে ফেলি তখন কি হবে?

মা কিঞ্চিত হাসির রেখা মুখে নিয়ে বললেন, "ধুর বোকা মেয়ে, আমি আছি তাহলে কি করতে?"

এভাবেই সবসময় পাশে থেকো বাবা মা।
______________

(কোনো মানুষই জন্ম থেকে সব শিখে আসেনা। তাকে হাতে ধরে শিখিয়ে পরিয়ে নিতে হয়। ছেলের বউকে যে সবটা বাবার বাড়ি থেকে জেনে আসবে এটা মনে করাটা ভুল। কারন বাবার বাড়িতে একটা মেয়ে বড় হয় খুব আদর যত্নে তাই সে ততোটা কাজকর্ম শিখে উঠতে পারেনা।

কারো ভুল হবার পরেও যদি সেই কাজটাতে উৎসাহ দেন, দেখবেন দ্বিতীয়বার আর সেই ভুলটা হবেনা আর।)

_____________________________________________________________________________

কলমে - প্রিয় চট্টোপাধ্যায়।

Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন