“করম পরব”
 আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোকউৎসব:
করম পরব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা ও বাঁকুড়া , ঝাড়গ্রাম ,পশ্চিম মেদিনীপুর ছাড়াও ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যার বিভিন্ন জেলায় হয় এবং ভারতের অন্যান্য আরো কিছু রাজ্য ও বাংলাদেশের কিছু অংশে এটি উদযাপিত হয়। কুড়মি,ভুমিজ, বীরহড়, খেরওয়ার, হো, খেড়িয়া, শবর, লোহার, মাহালি, সিংসরদার, সিংমুড়া, পাহাড়িয়া, বাউরী, হাড়ি, বাগদি, ঘাসি, মাহালি ও সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও প্রভৃতি সম্প্রদায়ের আরণ্যক ও কৃষিভিত্তিক লোকউৎসব।

পালনরীতি :
প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাতদিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন। তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলিকে রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিন পাক ঘোরে।তারপর পরস্পরের হাত ধরে এই টুপা কে কেন্দ্র করে গোল হয়ে গাইতে থাকে-

“আইসঅ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধইরে নাচি লো-
একমনে জাওয়া দিব,জাওয়া যেমন বাড়হে লো।
কাঁসাই লদির বালি আইনে জাওয়া পাতাব লো-
হামদের জাওয়া উঠে শাল ধুঁধের পারা লো।

বা,
“কাঁসাই লদির বালিয়ে জাওয়া পাতিব লো।
আমদে জাওয়া উপারে রণে তাল গাছের পারা লো।।
সুরজ উঠে খিনি খিনি আমার জাওয়া উঠে না।
জাওয়ার লাগি দিন উপাসগো।।
সাত দিনকার জাওয়ার লাগি দিন পালন করি গো।”
তাও আমরা জাওয়া পাতাব গো।

এভাবেই শুরু হয় ‘জাওয়া পাতা’।
 এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট, জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলিকে বুনা দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টানা হয়, যাকে বাগাল জাওয়া বলা হয়। এরপর ডালাতে ও টুপাতে বীজ বোনা হয়। এরপর প্রত্যেকের জাওয়া চিহ্নিত করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। একে জাওয়া পাতা বলা হয়। যে ডালায় একাধিক বীজ পোঁতা হয়, তাকে সাঙ্গী জাওয়া ডালা এবং যে ডালায় একটি বীজ পোঁতা হয়, তাকে একাঙ্গী জাওয়া ডালা বলা হয়। যে সমস্ত কুমারী মেয়েরা এই কাজ করেন, তাদের জাওয়ার মা বলা হয়। 
পুরুষেরা শাল গাছের ডাল বা ছাতাডাল সংগ্রহ করে আনেন। গ্রামের বয়স্কদের একটি নির্দিষ্ট করা স্থানে দুইটি করম ডাল এনে পুঁতে রাখা হয়, যা সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর বা করম গোঁলায় এবং ধরম ঠাকুর হিসেবে পূজিত হন। কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপোষ করে সন্ধ্যার পরে থালায় ফুল, ফল সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে এই স্থানে গিয়ে পূজা করেন। এরপর সারারাত ধরে নাচ গান চলে। পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন স্থানে সেগুলিকে ছড়িয়ে দেন।

করম গান ও নাচ:
এই পরবের মূল সম্পদ হল জাওয়া-গান।এই গানগুলোর কোনো লিখিত রূপ না পাওয়া গেলেও প্রতিটা গ্রামে বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ।
এই নাচ গানের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয় তাদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না,সুখ-দুঃখ।এই গানগুলো বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদও বলা যেতে পারে।

তবে এই গানগুলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই গানগুলো মূলত ছয়টি পর্যায়ের গান।
২.আচার মূলক,
২.ডহরা,
৩.আখড়া-বন্দনা
৪.চাষবাস সম্পর্কিত
৫.নারী কেন্দ্রিক সমাজ জীবন
এবং
৬.ভাসান

করম উৎসবের সময় সমস্ত রাত ধরে সুর্যোদয় পর্যন্ত সম্মিলিত ভাবে ভাদরিয়া ঝুমুর গান ও যৌথ নাচ পরিবেশিত হয়। এই নাচে সাধারণত অবিবাহিত ও প্রথম বছরের নববিবাহিতা মেয়েরাই অংশ গ্রহণ করে। নৃত্যশিল্পীরা অর্ধবৃত্তাকারে হাত ধরাধরি করে এক পা এগিয়ে পিছিয়ে জাওয়া ডালিগুলিকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করেন।

💛 আমার সংস্কৃতি আমার পরিচয় 💛
করম পরবের শুভেচ্ছা রইল ❣️

(অনিচ্ছাকৃত কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী)
লেখা-রাজেশ মাহাত।
তথ্যসূত্র-দিলীপ কুমার গোস্বামী, সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি, মানভূম সংষ্কৃতি-ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাতো।
ছবি-মোহন পরামানিক দাদা ।

Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন