Amabasya

শিরোনাম -অমাবস্যা

বাংলার সৌন্দর্যের মুকুট সুন্দরবনের নামখানা ব্লকের একটি অখ্যাত গ্রাম বালিয়ারা। ছবির মতো সুন্দর মৌসুনি দ্বীপের নাম শুনেননি এমন বাঙালি বোধয় তর্কের খাতিরেও মেলে না। সুন্দরবনের প্রায় একশোর উপর দ্বীপের মধ্যে মৌসুনি অন্যতম বিখ্যাত। চারিদিকে অগাধ বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে মৌসুনি দ্বীপ যেন রঙিন ভেলার মতো ভেসে বেড়ায়। যেকোনো প্রকৃতি প্রেমী হৃদয়ের তৃস্না মেটাতে মৌসুনি একাই যথেষ্ট।শহুরে কোলাহল আর অভিশাপ রুপী দূষণ থেকে বাচতে সমুদ্রের শুশ্রুষা অত্যন্ত উপযোগী। সুন্দেরবনের অন্য দ্বীপগুলোর থেকে মৌসুনি একটু আলাদা।


নীল সমুদ্রের গর্জন, মনোমোহি ম্যানগ্রোভের সুগন্ধ, গভীর নির্জনতার মধ্যে বাতাসে  ঝাউবনের গনগন শব্দ, রাতে টেন্টে আঁধারের সাথে সহবাস আর লাল কাঁকড়া সুললিত বিচরণ এই দ্বীপের মূল আকর্ষণ।

বালিয়ারা গ্রামের হতদরিদ্র মানুষ গুলোর রুজি রুটির একমাত্র আশ্রয় হল সাগর। অধিকাংশ মানুষই মৎসজীবি। ভোর হতেই  মানুষ এই সুবিশাল সাগরে গভীরে চলে যান মাছ ধরতে। অতল সমুদ্রের বুক চিরে নৌকা করে সারাদিন মাছ ধরে ফিরে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে যায়। এছাড়াও লাল কাঁকড়া ধরে বাইরে বিক্রি করেও এদের পেট ভরে। 


প্রকৃতির আশীর্বাদে ভরপুর বালিয়ারা গ্রামে বিশ্ব উস্নায়নের প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে।বছর বছর সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে আর রাক্ষসের মতো গিলে খাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, চাষের জমিঘর বাড়ি।

বালিয়ারা গ্রামের টিনের দেওয়ালে ঘেরা কুড়ে ঘরে দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে বাস করে করম মাঝি। লিজে নেওয়া একটা ভাঙাফুটা নৌকা সাগরের বুকে বেয়েই পেট চলে তার। স্ত্রী দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে চারজনের সংসার। সাগরের পেট চিরে মাছ ধরে কোনোরকমে সংসার চালায়। 


কাজলা কালো বছর তেরোর মেয়ে অমাবস্যা আর ছেলে অমল এর বয়স দশ। সে এক শ্রাবনের ঘোর অমাবস্যার রাতে জন্ম হয়ে ছিল বলে মেয়েটার নাম অমাবস্যা রাখে করমের স্ত্রী মনিমালা। 


করম আর মনিমালার কোল আলো করে আসে ফুটফুটে প্রানবন্ত অমা। কিন্তু মনোপুত হয়নি করমের। পরিশ্রম করে পেট চালাতে হয় বলে এদিকে পুরুষ মানুষের দাম বেশি। অমাবস্যার জন্ম হয়েছিল অবহেলা সঙ্গে নিয়ে।

ফুটফুটে অমা'কে কোলে  নিয়ে করম বলে

"ই বিটিছিলা ট লিয়েন হামি কি করমু

খাওয়ান দাওয়ান বড়ো কইরা আবার বিহাও দিতে হইবো "

'হ্যাগা উপরবালা এত নিঠুর কেন গোঁ

"বেটা ছিলা হইল সোনার আংটি, গতর খাইটা হামগো দু-মুঠা খাওয়াইত"



টিনের ঘরের কুঠুরিটাই সদ্য মা হওয়া মনিমালা ফ্যাকাসে মুখ করে ভাগ্যের নিঠুর পরিহাস উপলব্ধি করছিল। কোথায় ওর মা হওয়ার পরম খুশিতে উদ্বেলিত হওয়ার কথা তার বদলে  কপালে জুটল অবহেলা আর কটূক্তি। ক্রন্দনরত অমাও বোধয় পৃথিবী তে তার অবাঞ্চিত আগমন এর বার্তা পেয়ে যায়। জন্মদাতা পিতার কাছ থেকে যে শীতল আপ্যায়ন পেয়েছিলো অমা তার মধ্যে মরচে ধরা সমাজের পচা গলা রীতি নীতি। 


এদিকে এমন কত শত সদ্যজাত অমা'র ঠাই হয় হোগলা পাতার ঝোপে কিম্বা সাগরের জলে শুধু মাত্র মেয়ে হয়ে জন্মায় বলে। করম মাঝি চায় নি অমা কে বাঁচাতে কিন্তু মনিমালার মাত্র আত্মার অদম্য জেদের কাছে পেরে ওঠেনি করম। 


কালের নিয়মে বাদাবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া গাছের মতোই অযত্নেই বেড়ে উঠে অমা।

বছর তিনেক পরই সাধ পূরণ হয় করম মাঝির। পুত্র সন্তান অমলের জন্ম দেয় মনিমালা।

খুশির সীমা থাকেনা করম মাঝির 


"ও মনি এতদিনে মদের কথা উপরবালা শুইনাছেন",

দেখ দেখ, কেমন ফুটফুইটা পোলা গো হামদের কুইড়া ঘরে পাঠাইছোন

ফ্যাল ফ্যাল করে টিনের চাল টার দিকে চেয়ে থাকে মনিমালা। দুবার চোখের পলক ফেলেই শেষ নিঃস্বাস টা ত্যাগ করে।


অপুষ্টি আর বিশ্রামের অভাবেই মনিমালার জীর্ণ দেহটা এদিকের হাজার নারীর মতোই অকালে ঝরে যায়।

সদ্য প্রস্ফুটিত অমল কে কোলে নিয়ে নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে করম।

অভাবের তাড়নাই গুটিয়ে আসা লুঙ্গিটা ধরে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে থাকে তিন বছরের অমা। 


মনিমালা চলে যাওয়ার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার বিয়ে করে করম।

একদিন হটাৎ বৌ নিয়ে এসে হাজির হয় করম,

এই দেখ অমা তর লাগন লইতন মা নিয়া আইসস”,

"আজ থেকন ইটাই তর মা বঠে"


শৈশবের অবচেতন কিছুই বুঝতে দেয় না অমাকে।

তখনো বুঝে উঠতে পারেনি কি ভীষন যন্ত্রনা অপেক্ষা করে আছে ওর জন্য।

তার সৎ মার কাছ থেকে শুধু অবহেলা আর অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই পাই নি অমা।

বয়েস দশ বছর হওয়ার আগেই অমাকে ঘরের যাবতীয় কাজ করতে হতো। অমা র কোমল হাতের তালু অবজ্ঞার কালি লেপ্টে থাকতো সারাক্ষন।


হতভাগ্য অমা'র হাতের অদৃশ্য ভাগ্য রেখাগুলো ভাতের হাড়ির পোড়া কালির সঙ্গেই উঠে গিয়েছিলো।

"সারাদিন শুধু বইগুলোন লিয়ে বইসে থাক, কাজকম্মো কিসসু করতে হাইম না", মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে অমাকে বলতে থাকে ওর সৎ মা।

বলি, লেখা পড়া কইরা কোন বড়লোক হইবো?

বড়ো হইয়া খন বিহা হইলে শশুর ঘর গিয়া কি কম্মো করতে হইবো না বুঝি?”



কথাগুলো শুধু অমার সৎ মায়ের নয় এদিকের মানুষদের চিরাচরিত ধ্যানধারণা যে মেয়েদের বেশি লেখাপড়া শিখিয়ে লাভ নেই। 


অসম্ভব জেদি অমা এসব মানত না। ও বিশ্বাস করতো লেখা পড়াই বাঁচার একমাত্র পথ। ওর সৎ মা যাই বলুক ও মনে মনে স্থির করে নিয়েছিল যত বাধাই আসুক ও পড়াশুনা চালিয়ে যাবে। বাধ্য ও মনোযোগী ছাত্রী হিসাবে নাম ছিল অমার। 


বালিয়ারা স্কুলের স্বাতী ম্যাডাম ওকে খুব ভালোবাসতেন। ক্লাসের ইউনিট টেস্ট গুলোতে ভালো রেজাল্ট করলেই ওকে নানান উপহার দিতেন। খালি বলতেন-

" লেখাপড়া শিখে অনেক বড়ো হতে হবে অমা,

অনেক বড় মানুষ হতে হবে। জানিস আজকাল আর মেয়েরা পিছিয়ে নেই।

মেয়েরাই দেশ চালাচ্ছে। তোরাও হয়তো একদিন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবি"



দিদি মনির কথা গুলো অমা গালে হাত দিয়ে মন দিয়ে শুনে। কল্পনায় নিজেকে ডাক্তার হিসাবে ভাবতে থাকে। ওর রুগ্ন শরীরটা যেন আবেগের ঝটকায় কাঁপতে থাকে। ও বেমালুম ভুলে যায় যে স্কুল থেকে ফিরেই ওর সৎ মা হাজার টা কাজের ফর্দ নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। ওর কলম চালানো কচি হাত দুটো কাঠের উনুনে পুড়ে দুবেলা খাবারের জোগাড় করায় ব্যাস্ত থাকে।



অমা'র ছোট্ট লড়াকু জীবনের সবথেকে বড় পরীক্ষা হয়ে আসে সেবছরের ঘূর্ণিঝড় আইলা। ছোটোখাটো ঝড় তুফান এদিকে সাধারণ ব্যাপার হলেও, আইলা গত একশো বছরের সবথেকে ধ্বংসাত্মক ছিল। প্রবল ঝঞ্জায় পুরো তছনছ হয়ে যায় সুন্দরবন। 


ভুলন্ঠিত হয় সুন্দরী সাজে সজ্জিত ম্যানগ্রোভ। অমাদের কুড়ে ঘর টা উড়ে গিয়ে পাশের খেতে পড়ে। উলঙ্গ করে দেয় অমার স্বপ্নের ছাদ টা। 


এক মানুষ জলের নিচে চলে ঘরের ছেঁড়া খাট দুটো। আর অমা'র যত বইখাতা গুলো জলের তোড়ে কতদূর নিয়ে যায় জানেনা কেউই। স্কুলের ত্রাণ শিবিরে বোসে হাও হাও করে কাঁদতে থাকে অমা। ওর উপলব্ধি হয়ে গিয়েছিলো আর বোধয় ওর লেখাপড়া করা হল না। ওর সাধের স্বপ্ন ডাক্তার হওয়াকল্পনার ঠুনকো দেওয়ালেই লেপ্টে থাকবে।


কোনো বড়োলোকের ঘরে ফাইফরমাশ কাজ আর অবিরত লাঞ্ছনাই ওর ভবিতব্য। এদিকের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই পরিণতি হবে ওর। অমা'র মতো সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল গুলো আইলার মতো বিপর্যয়ের ঘায়ে শেষ হয়ে যায়।

****************************************
কলমে- রঘুনাথ সিংহ মহাপাত্র।

2 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন