"অন্য শ্রাবণ"


সারাটাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে।  সকাল শেষ হতে না হতেই চারিপাশে স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে শুরু হয়েছে অঝোর বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টির মৃদঙ্গ সুরে প্রাণে হিল্লোল বয়ে যায়। যেদিকে তাকানো যায়, যতদূর দৃষ্টি যায় ,দেখা যায় বিরামহীন বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দের তাল বুনছে। যে তালে নিজেকে ছাপিয়ে নিয়ে যেতে মন চায় অনন্য এক সৌন্দর্য্য এ। টিনের চালে, গাছ-গাছালিতে বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির মনোমুগ্ধকর শব্দে। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির ফোটাগুলো পুকুর তার দুই হাত মেলে সাদরে গ্রহণ করছে। বৃষ্টির সাদা সাদা মার্বেলের মত ফোঁটাগুলো পুকুরে পড়তে দেখে, পুকুরে বিদ্যমান শাপলা ফুল ও হেলেঞ্চা গুলো মনে হচ্ছে আনন্দে আত্মহারা। তাইতো বন্য হাওয়ায় ঢেউ খেলে উঠছে তাদের শরীরে। হাসিমুখে তারাও যেনো তা উপভোগ করছে মত। 

এই ভরা শ্রাবণে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ইচ্ছে হয় ওর। খুব ইচ্ছে করে মনের সুখে খুব করে ভিজিয়ে নিতে নিজেকে। একদিন কি হয়েছে ঘন কালো মেঘে আকাশ বাতাস উতলা হয়ে উঠেছে। গাছ গুলো হওয়ায় কি ভীষন রকমের দুলতে শুরু করছে। হঠাৎ আসা ধুলো ঝড়ে চোখ দিয়ে তাকাতে পারছে না বিল্টু। স্কুল থেকে ফেরার পথে মেঠো পথের আগালে ঠায় দাড়িয়ে রয়েছে সে। ভয়ে, উত্তেজনায়। খুব কাছেই দুড়াম করে বাজ পড়লো যেনো। এবার দুকানে হাত রেখে বসে পড়েছে ও। মনে হলো যেনো মেঘ ভেঙে পড়বে মাথায়। কিন্তু ভরসার হাত কাঁধে পড়তেই চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখে ,"বাবা!" কে। ঘটনা টা মনে পড়তেই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো গায়ে। সেদিন খুব ভিজেছিল বাপ ব্যাটা তে মিলে। ঘরে ফিরে মায়ের বকুনিও খেয়েছিল। মা যখন বলছিলো, বাবা চোখ মিটমিট করে তাকিয়ে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল । বেশ দেখেছিল সে। কতোদিন হয়ে গেলে বাবাকে দেখেনা আর। বাবা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সেই যে হাসপাতাল থেকে গাড়ী এসে বাবাকে নিয়ে গেলো কারা প্লাস্টিক সারা গায়ে জড়িয়ে! তারপর থেকে বাবা আর ফিরে আসেনি। মায়ের ও কপালে আর বড় করে পরা সিঁদুরের টিপ টুকু নেই! মা কতো চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল। তেমন করে কখনো হাসে না, শুধু চেয়ে থাকে। রাতে বিছানায় মায়ের পাশে শুয়ে সে বুঝতে পারে মা কাঁদছে। প্রশ্ন করে না, শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে ।

ওর স্কুলের বন্ধুর বাড়িতে নাকি আজ তালের পিঠে হবে রাত্রে, স্কুলে এ কথা শুনেছে সে। পাতা সেদ্ধ পিঠে, তালের লুচি, তালের বড়া, তালের পায়েস কতকিছু হবে। 
তালের পায়েস সে কখনো খায়নি। বাড়ী এসে মা কে জিজ্ঞেস করে কতোবার, মা যে তালগুলো কুড়িয়ে এনেছে, ওগুলো দিয়ে কতরকম পিঠে করা যেতে পারে। বিল্টুর বন্ধুর বাড়ী যেহেতু সামনেই ওর বাড়ী থেকে তাই বিল্টু ভাবে বৃষ্টি থামলেই সে ওখানে গিয়ে দেখে আসবে, কতো রকমারি পিঠের আসর বসেছে।

ওই বাড়ির বড় জ্যাঠিমা বিল্টুকে ডাকতে আসেন, ছোট্ট বিল্টু গিয়ে আসনের উপর বসে। একে একে পাতে পড়ে পূর ভরা পাতা সেদ্ধ পিঠে, তুলতুলে তালের বড়া, লুচি, পায়েস কতকিছু! বড়া একটা মুখে টুপ করে পুরে নিয়ে দেখবে কতো মজার হয়েছে, তখুনি টুপটাপ করে জল এসে পড়ে বদ্ধ চোখের পাতায়! স্বপ্ন টা ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ!!

ওর চোখ যায় মায়ের দিকে। মা ভেজা উনুনে জাল দিচ্ছে, ধোঁয়ায় ভরে গেছে ওদের আধ ভাঙা বারান্দা টা! 

চাল ভিজানো রয়েছে। মা পোড়া পিঠে বানিয়ে দেবে বিল্টু কে। ও বাড়ীর কাজের মেয়ে এসেছে ছাতা নিয়ে, বিল্টুর মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া তাল গুলো নিয়ে যেতে!

বিল্টু চেয়ে চেয়ে দেখে একটা তাল, দুটো, তিনটে, চারটে!! আস্তে আস্তে তাল ব্যাগে নিয়ে ছাতা মাথায় দেওয়া মানুষটি সামনে চলতে থাকে! যেতে যেতে চোখের অগোচরে চলে যায়! বিল্টু র বুকে মেঘ জমে আসে! চোখ ভিজে যায় শ্রাবণে!!

কলমে- শম্পা পতি

Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন