অফবিট মামুডি

নেতারহাট  ট্রিপ এর রেশ কাটতে না কাটতেই আরো একটা প্ল্যান ...
অফিসের কলিগদের আবদারে একটা ছোট প্ল্যান করতেই হলো।
যথারীতি এই গ্রুপ এ ঘেটেঘুটে প্ল্যান করলাম যে এবারে আমরা  5 জন মিলে একটা অফবিট ডেস্টিনেশন যাবো । এবারে মাত্র এক নাইট স্টে তাই সব দিক ভেবে ঠিক করলাম আমাদের গন্তব্য হোক মামুডি।এটা পুরুলিয়ার অযোধ্যা সার্কিটের পশ্চিমদিকে অবস্থিত একটি আদিবাসী গ্রাম, যেটি ঘন জঙ্গল এবং পাহাড় পরিবেষ্টিত।ওখানে থাকার অপশন খুবই কম, কিছুই প্রায় নেই বললেই চলে,তাই জলদি ফোনে জয়ন্ত বাবুর সাথে কথা বলে আমরা বুক করলাম কুইন হিল ভিউ ইকো রিসোর্ট। খুবই অমায়িক এই ভদ্রলোক।

সৌভাগ্যক্রমে আমরা যাওয়ার আর ফেরার ট্রেন টিকিট ও পেয়ে গেলাম। যাওয়ার জন্য তৎকালে হাওড়া স্টেশন থেকে ক্রিয়া যোগা এক্সপ্রেস , মুরি জংশন এ নামা আর ফেরা পুরুলিয়া জংশন থেকে রূপসী বাংলা ধরে হাওড়া। 

কিছুদিন আগেই আপনাদের সাথে বর্ষার নেতারহাট এবং রাঁচি ঘোরার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম। এবারও আমাদের যাত্রা সেই একই ট্রেনে। সময়মতো স্টেশন এ পৌঁছে আমরা ক্রিয়াযোগা তে চেপে বসলাম। ভোরবেলা 4 টের সময়  মুরি স্টেশনে নামলাম।ওহ আপনাদের বলতেই ভুলে গেছি, রিসর্টের জয়ন্ত বাবুর থেকেই আমরা ফাল্গুনী দার কন্ট্যাক্ট পেয়েছিলাম গাড়ির জন্য। স্টেশনে নেমে চা খেতে খেতেই উনি আর্টিগা নিয়ে হাজির। চা খাওয়া শেষ করে আমরা চেপে বসলাম। তারপর আস্তে আস্তে আলো আঁধারি পথ অতিক্রম করে পাহাড়ে ওঠা শুরু হলো ।প্রকৃতির রূপ ও বদলাতে শুরু করলো, সবাই যে যার ক্যামেরা আর মুঠোফোন নিয়ে তৈরি সেই মুহূর্ত গুলো বন্দী করার জন্য। 

রাস্তায় একটু চা বিরতি নিয়ে আমরা প্রথমে পৌঁছলাম মুরুগামা ড্যাম। এই জায়গাটা খুব পরিচিত এবং সকলেই জানেন যে এটা কতটা সুন্দর। তারপর ওখানে একটু সময় কাটিয়ে, ছবি তোলা শেষ করে আমরা যাত্রা শুরু করলাম মামুডির দিকে। ওখান থেকে  বেশ কিছুটা রাস্তা অতিক্রম করে ওপরে উঠে আমরা পৌঁছলাম কুইন হিল ভিউতে। মূরুগামা থেকে পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ি রাস্তা আর চারদিকে ঘন জঙ্গল , বর্ষায় তার সবুজবরণ রূপ। প্রতিটা টার্ন এ তার সৌন্দর্য কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না।চারদিকে শুধু ঘন সবুজ আর সবুজ। রিসোর্টে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে লুচি,তরকারি সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য মাছকান্দা ফলস। গাড়ি করে কিছুটা পথ গিয়ে এবার হাঁটার পালা। তবে সেটা কম নয় প্রায় 2.1 কিমি এবং সেটা একদম ঘনও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ চরাই উতরাই, সাথে স্থানীয় গাইড একদম মাস্ট, আজকে ফাল্গুনী দা এবং জয়ন্ত দা দুজনেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন গাইড হিসেবে।রাস্তাটি হাতি দের খুব পছন্দের তার প্রমাণ ও পেলাম অনেক জায়গায় এবং আরো শুনলাম যে ওখানে অনেক ভাল্লুক ও আছে, জঙ্গলের ভেতর এর রাস্তায় ভাল্লুকের পায়ের ছাপ ও দেখালো ফাল্গুনী দা। ওই রাস্তায় আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না সেই সময়।বেশ ভয় ভয় লাগছিল, তবে কথায় আছে ভয়কে জয় করার মজাটাই আলাদা। যাইহোক বেশ কষ্ট করে শেষে তার দেখা মিললো, যদিও তার গর্জন আগেই শুনতে পাচ্ছিলাম। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে তার অবস্থান জঙ্গলের মাঝে। তবে তার অকৃত্তিম অস্পর্শিত সৌন্দর্য ভাষায় বলে বোঝানো যাবে না। সেখানে বেশ অনেকটা নিচে অবধি আমরা পাথর বেয়ে নামতে পেরেছিলাম বেশ কসরত করে, সেই কষ্ট নিমেষে উধাও হলো তার সান্নিধ্য পেয়ে। বেশ অনেকক্ষণ সেখানে সময় কাটালাম, ফটো সেশন হলো, স্নান হলো মনের সুখে ।মন না চাইলেও আবার সেই একই জঙ্গলের রাস্তা ধরে ফিরতে হবে গাড়ির কাছে। অতোটা রাস্তা ওরম ওঠানামা করে সবাই একটু হাফিয়ে গেছিলাম, তাই একটু ওয়েট করে,জল খেয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম সবাই ।গাড়ি এগোতে লাগলো পরের গন্তব্যের দিকে। আবারো বলে রাখি এটার রাস্তাটা কিন্তু বেশ চ্যালেঞ্জিং, তাই সবার পক্ষে নাও সম্ভব হতে পারে।

এরপর আমরা ঠিক করলাম লাঞ্চএর আগেই আমরা আর একটা ফলস দেখে নেবো। সেটার নাম টাও আমাদের আগে জানা ছিল না ,ধাদকিকচা ফলস। আবার যথারীতি গাড়ি টা রাস্তার ধারে রেখে ফাল্গুনী দার কথা মত জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম সবাই লাইন দিয়ে।কিছুটা এগোনোর পর তার তীব্র আওয়াজ ও আমাদের কানে এলো।আওয়াজ আন্দাজ করে আমরা জঙ্গলের গাছের ডালপালা সরিয়ে এগোতে লাগলাম কিন্তু বেশ কিছুটা এগিয়ে আর শেষ অবধি যাওয়ার রাস্তা পেলাম না আর সত্যি বলতে কি সহসেও কুলোলো না কারোর।ফিরে আস্তে হলো বাধ্য হয়ে। ফেরার পথে একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে গজাবুরু / হাতিপাহাড় দেখলাম । খুব সুন্দর তার রূপ।
এরপর রিসোর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সারলাম সবাই।তারপর কিছুটা রেস্ট নিয়েই আবার ফাল্গুনী দার সাথে বেরিয়ে পড়ার পালা। সকাল থেকেই  ধাদকিকচা ফলস দেখতে না পাওয়ার জন্য মন টা খচখচ করছিল সবার।তাই ঠিক করা হলো আর একবার আমরা এটেম্পট নেবো এটা এক্সপ্লোর করার। কিন্তু বর্ষার জন্য জঙ্গলে আরো ঘন হয়ে যাওয়ায় সেই রাস্তা আবারও পাওয়া গেলো না, তাই আর সময় নষ্ট না করে আমরা দেখে নিলাম পাঁড়রি লেক যেটা চেমটাবুরু পাহাড়ের পাদদেশে।এই জায়গাটাও খুবই সুন্দর আর চারদিকে সবুজের সমারোহ। লেকের জল টা খুব পরিষ্কার ,টলটলে আর তাতে পাহাড় আর পাদদেশের গাছপালার পুরো প্রতিবিম্ব , অদ্ভুত সে দৃশ্য। সেখান থেকে আমাদের আজকের মতো শেষ গন্তব্য পিতিটিরি ফলস। এটা চেমটাবুরু থেকে 20 মিনিটের রাস্তা।আবারও গাড়ি রেখে জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা ধরতে হলো, মাঝে একটা সরু নদীও পড়লো যেটা পায়ে হেঁটেই ক্রস করা যায়।তারপর পৌঁছলাম ফলসের কাছে,তখন কিছুটা অন্ধকার ও হয়ে এসেছে।তার মধ্যেই কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা আবার রিসোর্ট ফিরে এলাম। মাঝে মধ্যেই অল্প বিস্তর বৃষ্টি পেলাম।

পরের দিন আমাদের ফেরার ট্রেন দুপুর 3:40 এ। তাই তার আগে কি কি জায়গা দেখে নেওয়া যায় তার একটা প্ল্যান করে ফেললাম ভেজ পকোড়া, মুড়ি আর চা খেতে খেতে। রাতে আমরা একটা নতুন আইটেম খেয়েছি জয়ন্ত দার সৌজন্যে , ওখানকার দেশি হাঁসের কষা মাংস আর রুটি। সেই টেস্ট ভোলার নয়। বিশ্বাস নাহলে সেটা নাহয় আপনারাই পরখ করে দেখে নেবেন সময় মতো। সারাদিন অনেক হাঁটাহাঁটি আর ঘোরার পর সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই।

পরদিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা তল্পিতল্পা গুছিয়ে একেবারে বেরিয়ে পড়লাম মামুডিকে বিদায় জানিয়ে।কথা দিলাম যে আবার ফিরে আসবো ।পুরুলিয়া স্টেশন যাওয়ার পথে একে একে দেখে নিলাম মার্বেল লেক, তুর্গা ফলস,অযোধ্যা হিল টপ, আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম, জিগজ্যাগ ভিউ পয়েন্ট। এগুলো নিয়ে আলাদা করে আর বলার কিছু নেই। কারণ এগুলো রেগুলার পুরুলিয়া স্পট এর মধ্যেই পড়ে।

তবে শেষে একটা কথা না বললেই নয়, আমাদের ড্রাইভার ফাল্গুনী খুব ভালো ঘুরিয়েছে, কিছু বলার নেই। আপনারা চাইলে কন্ট্যাক্ট করতেই পারেন নিশ্চিন্তে । 
ফাল্গুনী  +91 74791 59012
কুইন হিল ভিউ ইকো রিসোর্ট- জয়ন্ত দা - 86702 14030

আমাদের পারহেড থাকা খাওয়া মিলিয়ে 1400 করে পড়েছিল।আর গাড়ি ভাড়া বাবদ টোটাল 7000 ।

আপনাদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্য এই লেখা আর ক্যামেরা এবং মুঠোফোনে তোলা কিছু ছবি দিলাম, দেখে মতামত জানতে ভুলবেন না। আর ভাষাগত ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন ।

লেখা ও ছবি- Sankha Dutta

Post a Comment

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন