বিশ্বাসঘাতক
আজ অফিসের ছুটি ছিলো,
ইচ্ছে করেই একটু বেশিক্ষণ ঘুমাচ্ছিল জয় । কিন্তু ফোনের রিং বাজার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেলো। বিছানাতেই উঠে বসলো জয়, ফোন হাতে নিয়ে দেখলো কোনো অজানা নম্বর থেকে কল টা আসছে।
কানে নিয়ে হেলো করতেই ওপর প্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো কোনো বাচ্চা মেয়ের।
হ্যালো !! আমি কি জয় বাবুর সাথে কথা বলছি??
জয়- হ্যাঁ, কে বলছো?
: আমি পিউ , আপনার বন্ধু জিৎ এর মেয়ে ।
শুনে জয় এর পৃথিবী টা যেন থমকে গেলো, 15 বছর আগে ঘটে যাওয়া অঘটন এক নিমেষে সব মনে করিয়ে দিলো। জয় পুরো স্তব্ধ , কোনো আওয়াজ নেই।
কিছুক্ষন পরে আবার পিউ বলে উঠলো, "হ্যালো !! শুনছেন কাকু?? "
জয় তখন অতীতে কোথাও হারিয়ে ছিল, একপ্রকার হুঁশে ফিরে বললো
হ্যাঁ মা বল, কেমন আছিস?? তোর বাবা কেমন আছে ??
এতক্ষনে পিউ কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে!!
কেঁদে কেঁদে বললো বাবা ঠিক নেই কাকু, কালকে রাতে হার্ট এট্যাক করেছে। এখন হাসপাতালে ICU তে আছে।
বাবা আপনার সাথে দেখা করতে চাই , অজ্ঞান অবস্থায় শুধু আপনার নাম নিচ্ছে বাবা।
বাবার ফোন থেকেই আপনাকে ফোন করলাম। আপনি প্লিজ একবার হাসপাতালে আসতে পারবেন?? প্লিজ কাকু !!
জয় দিব্যি খেয়েছিল , বেঁচে থাকতে আর জিত বা মনির মুখ দেখবে না ।
কিন্তু পিউর কাতর আবেদনে সে না করতে পারলো না ।
ঠিক আছে মা কাঁদিস না, আমি এক্ষুনি আসছি বলে ফোন রাখলো।
ড্রাইভার কে ফোন করে গেট এ গাড়ি লাগাতে বললো,
তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে নেমে গাড়িতে বসে ড্রাইভার কে বললো হাসপাতালে যেতে।
গাড়িতে বসেই জয় কোনো এক ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল,
সালটা 2004-05 , সবে মাত্র কলেজ শেষ হয়েছে ।
জয় আর জিৎ স্কুল থেকে বন্ধু
মনির সাথে কলেজে পরিচয় । মনি তখন জয় এর প্রেমিকা। জয় প্রচন্ড ভালোবাসতো মনি কে।
পোস্ট অফিসের মোড়ে ট্রাফিক আটকে হাটু গেড়ে প্রপোজ করেছিলো সে , সিনেমার স্টাইলে। বাবার কান অবধি খবর চলে গিয়েছিল, কত বকুনি খেয়েছিল। সেদিনই জয় বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিল , সে মনিকেই বিয়ে করবে।
আর এইসব কিছুতে তার সাথে ছিল জিৎ, জয় এর বেস্ট ফ্রেন্ড। নিজের ভাই এর মতো ভালোবাসতো সে জিৎ কে।
এভাবেই চলছিল তাদের জীবন। বছরখানেক পরে জয় চাকরি পেয়ে যায় , একটি আমেরিকান মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে । 2 বছর আমেরিকা গিয়ে থাকতে হবে , তারপর ভারতে ট্রান্সফার নিতে পারবে।
জয় খুব খুশি , সে তার স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে।
কিন্তু বিধাতার কলমে অন্যকিছু লেখা ছিলো, জয়ের বাবার কারখানায় আগুন লেগে যায় , তারা নিমেষে সর্বহারা হয়।
ঘর বাড়ি জমি জায়গা সবকিছু নিলাম হয়ে যায়।
তাদের একমাত্র সাহারা বলতে বেঁচে থাকে জয় এর আমেরিকার চাকরি টা।
মা- বাবা আর ছোট বোন কে গ্রামের বাড়িতে রেখে জয় পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পাড়ি দেয় সাত সমুদ্র পারে ।
সময়ের সাথে সবকিছু ছন্দে ফিরে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জয় প্রচুর টাকা ইনকাম করে, দু-বছরের মধ্যে বাবার সমস্ত ঋণ শোধ করে, ট্রান্সফার নিয়ে ভারতে ফিরে আসে সে।
এই দু-বছরে তার মনেই ছিলোনা মণি কে ।
ভারতে ফিরে তার মনে পড়ে জিৎ আর মনি কে ।শহরে ফিরতেই সে জিৎ এর বাড়ী যায় প্রথমে,
দরজায় কড়া নেড়ে ডাক দেয়,
কই রে হারামি !!!! দরজা খোল শালা!
দরজা খুলতেই তার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম।
জিতের বাড়ির দরজা খুলেছে মণি,
মাথায় সিঁদুর আর কোলে বছর দেড়েকে এর একটা বাচ্চা, পিউ।
বুঝতে দেরি হয়নি তারা বিয়ে করেছে।
জয় নিজের চোখ কে বিশ্বাস করাতে পারেনি।
তার বেস্ট ফ্রেন্ড আর প্রেমিকা তার সাথে এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে , সেটা কল্পনাতীত ছিলো।
রাগে ঘৃণায় সে জ্বলছিল সেদিন, জিৎ বাড়িতেই ছিলো , কোনো কাজে ব্যস্ত ছিলো।
বাইরে এসে জয় কে দেখে খুশিতে একপ্রকার লাফিয়ে উঠে।
জয় তুই এসে গেছিস ভাই , আই আই বলে সে জয়কে বুকে টেনে নিতে ছুটে আসে
হয় রাগ সংবরণ করতে পারেনি সেদিন
চেঁচিয়ে বলেছিল শুয়োরের বাচ্চা, আমার সাথে এটা করতে পারলি তুই ?????
জিৎ : আরে ভাই কথাটা শুনে নে আমার, যা ভাবছিস তা নই, একটিবার কথা শোন আমার।
জয়: কি শুনবো রে , কুকুর , যা দেখছি তার চেয়েও বেশি কিছু শুনতে লাগবে আমার!!!!!! শালা বিশ্বাসঘাতক , বেঈমান
জিৎ: ভাই, না জেনে গালাগালি দিস না , আগে কথাটা শুনে নে আমার।
জয়ের মাথায় তখন রাগে শয়তান বিরাজ করছিল, সে রাগ সামলাতে না পেরে জিৎ কে ধাক্কা মারে, জিৎ পড়ে যায় মেঝেতে, মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে।
মণি চেঁচিয়ে ওঠে , তাদের চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে পাড়া পড়শী জমায়েত হয় । কান্ড দেখে তারা জয় কে ঘিরে ফেলে,
জিৎ কে হাসপাতালে নিয়ে যায় , জয় কে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
3 4 দিন পরে জিৎ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে সে সোজা থানায় যায় , জয় এর বেল করায়, তার বিরুদ্ধে সমস্ত কেস তুলে নেই।
জয় কে আবার বোঝানোর চেষ্টা করে , জয় কিছু শুনতে চাইনি!
সে শুধু এইটুকু বলে যে , এই মুখ যেন আমি আর না দেখি ,
যদি আমার সামনে আসিস তাহলে হয় আমি তোকে খুন করে দেব নাহলে নিজেকে শেষ করে দেব।
তারপর 15 টা বছর কেটে গেছে , আর খোঁজ খবর নেই।
জয় বিয়েও করেনি। বন্ধুত্ব - ভালোবাসার প্রতি সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিল।
গাড়িতে বসে জয় পুরোনো স্মৃতিতে হারিয়ে গেছিল। হটাৎ গাড়ির হর্ণে , বাস্তবে ফিরলো।
ড্রাইভার মিরর এ দেখলো জয় ঘেমে উঠেছে
ড্রাইভার বললো, "স্যার AC টা চালিয়ে দিই?"
হ্যাঁ চালা , বলে জয় পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুখ মুছলো।
তারপর হাসপাতালে পৌঁছে রিসেপশনে খোঁজ নিলো ICU টা কোনদিকে।
লিফটে উঠে সে পৌঁছে দেখলো , রুমের বাইরে একটা 15- 16এর একটি মেয়ে চেয়ারে বসে আছে।
চোখ বেয়ে অশ্রুর ছাপ গাল পর্যন্ত, সারারাত কেঁদেছে সে বুঝতে দেরি হয়নি।
জয় জিজ্ঞেস করলো,
তুই পিউ??
পিউ চোখ তুলে তাকিয়ে বললো , হ্যাঁ, আপনি??
আমি জয় ! তোর বাবার বন্ধু।
পিউ: আসুন কাকু। থ্যাংক ইউ, বাবা রাত থেকে শুধু আপনার নাম নিচ্ছে।
জয় চারপাশে তাকিয়ে , আর কাউকে দেখতে না পেয়ে , একপ্রকার কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করলো, " আর তোর মা কোথায়? "
পিউ বললো , মা তো নেই, বাবা বলে আমার বয়স যখন 3 বছর তখনই মা মারা গেছিলো। আর আজকে বাবাও এই অবস্থায়, বলে পিউ আবার কেঁদে ফেললো।
জয় এর সমস্ত অভিমান, ঘৃণা যেন এক নিমেষে বিলীন হয়ে গেলো পিউর কান্না দেখে।
জয় পিউ কে বুকে টেনে নিয়ে বললো, কাঁদিস না মা, তোর বাবার কিছু হবে না। সে সুস্থ হয়ে যাবে।
ICU থেকে নার্স বেরিয়ে বললো , জিৎ দাসের পরিবারের থেকে কে আছেন?
জয় বললো, হ্যাঁ বলুন!!
নার্স বললো, পেশেন্ট জ্ঞানে ফিরেছে, কোনো জয় কে ডাকছে।
জয় বললো , আমিই জয়।
নার্স বললো , আসুন
নার্সের পেছনে জয় ICU এর ভেতরে পা বাড়ালো।
15 বছর পরে সে জিৎ কে দেখবে, ভেতর টা কেমন যেন করছে ।
বেড এর পাশে দাঁড়িয়ে জয় জিতের মাথায় হাত বুলিয়ে , জয় ডাক দিলো , " ভাইইই"
জিৎ চোখ খুলে তাকালো,
হাত দিয়ে মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক টা সরিয়ে বললো , জয় এসে গেছিস ভাই!! আই।
হ্যাঁ, ভাই কি অবস্থা করে নিয়েছিস নিজের ??
কিছুনা ভাই, বুকের বোঝা সইতে পারছিলাম না , আর পারছিলাম না , এবার বিদায় নেওয়ার পালা এসেছে।
তোকে কিছু বলার আছে, বলতে না পারলে মরেও শান্তি পেতাম না । আই ভাই বস।
চুপ কর শালা, কিছু হবে না তোর, এই বলে জয় জিতের হাত টা ধরলো শক্ত করে।
জিৎ বলতে শুরু করলো,
তোর মনে আছে জয় , তোদের ফ্যাক্টরি তে আগুন লেগেছিল, তোদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছিল। তারপর তোর বিদেশে যাওয়া । নিজের পরিশ্রমে আবার সবকিছু ঠিক করা।
দেশের মাটিতে ফিরে আসা।
তারপর আমার বাড়িতে এসে তুই দেখলি , মণি কে !!
জয় মাঝে থামিয়ে বললো , ছাড় না এসব কথা এখন!!
জিৎ বললো, প্লিজ জয়, সময় নেই আমার হাতে আমাকে শেষ করতে দে।
তুই আমার বাড়ি ফিরে দেখলি , মণির সিঁথি তে সিঁদুর আর কোলে বাচ্চা,
তা দেখে প্রত্যেকের মনেই হবে আমরা বিয়ে করেছি !
কিন্তু , কি হয়েছিল সেটা তুই একবারও জানার প্রয়োজন মনে করিস নি !!
জয়: আহ! ছাড় না ভাই ওসব, অনেক পুরোনো ঘটনা আমি ভুলে গেছি।
জিৎ: চুপ শালা!! চুপচাপ শুন
তুই সেসময় তো ভুলেই গেছিলি মণি নামে কেও আছে তোর জীবনে। পরিস্থিতি সত্যিই ওরকম ছিলো। তোর দোষ ছিলো না
কিন্তু তোর আমেরিকা যাওয়ার 7 দিনের মাথায় , মণি বুঝতে পারে সে প্রেগনেন্ট।
তোর সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি।
মণি নিরুপায় হয়ে আমার কাছে এসেছিল।
তার পরিবার থেকে প্রেসার দিচ্ছিল এবর্শন এর জন্য।
কিন্তু সে কোনোমতে তোর বাচ্চাকে নষ্ট করতে রাজি হয়নি। মণির বাবা তাকে আর গ্রহণ করতে পারেনি, বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে।
নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল মণি।
আমি ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম , বউ হিসেবে না বোন হিসেবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো , তুই ফিরে এসে মণি কে সাদরে গ্রহণ করবি।
সমাজের চোখ রাঙানি থেকে বাঁচার জন্য সে সিঁদুর পরতো। তোর নামের সিঁদুর।
কিন্তু.......!!!!
এই বলে জিৎ জ্ঞান হারালো
জয় এই পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে ততক্ষণে!!
নার্স ডাক্তার কে ডাকতে অফিসে ছুটলো
ডাক্তার এসে চেক করে নিশ্চিত করলো , জিৎ আর নেই ।
সন্ধ্যার সময় হাসপাতাল বডি দিলো , জিতের শেষকৃত্য সম্পন্ন করলো জয় নিজের হাতে।
তারপর পিউ কে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
পিউ কাল রাত থেকে কিছু খাইনি, ফিরে রান্নার মাসিকে খাবার বানাতে বললো।
জিতের অস্থির কলস ঠাকুর ঘরে রেখে , স্নান করে এসে পিউ কে নিয়ে খেতে বসলো।
পিউ তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
জয় পিউ কে কাঁদিস না মা, বলে কোলে তুলে নিলো,
চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
তুই আজ থেকে আমার মেয়ে, তোর বাবার অভাব তো পূরণ করতে পারবো না, তবে তোর কাকাই ও তোকে খুব ভালোবাসবে মা।
পিউ কান্না থামিয়ে বললো, বাবা আমাকে বলেছে, তোর জয় কাকু তোকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসবে।
এটা শুনে জয় কান্না ধরে রাখতে পারলো না, খানিকক্ষণ কেঁদে চুপ করলো।
পিউ কে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।
তারপর তাকে ঘুম পাড়িয়ে ব্যালকনি তে এলো
একটা সিগারেট ধরালো,
আজকে তার অশ্রু থামছে না ,
নিজের প্রতি তার ঘৃণা হচ্ছে, মরে যেতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু পিউ র দায়িত্ব তার উপর, তার পিউ , নিজের সন্তান।
যদিও নিজের বলার অধিকার আর যোগ্যতা তার নেই।
সিগারেট টা নিভিয়ে আকাশে তাকালো জয়
ঘন কালো মেঘ এ ঢাকা আকাশ , সেদিকেই তাকিয়ে কোনো অদৃষ্ট কে উদ্দেশ্য করে জয় বললো
ক্ষমা করে দিও , মণি
আর জিৎ তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার ও অধিকার নেই আমার, ভাই আমার, আমি আজীবন তোর দোষী থাকবো।
লেখা - Ranjit Das
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.